আপনি কি কখনও ভেবেছেন কেন কিছু পরিবার অনায়াসে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সম্পদ হস্তান্তর করে, আর অন্যরা আর্থিক অস্থিরতার চক্র ভাঙতে হিমশিম খায়? *বংশগত সম্পদ* গড়ে তোলা শুধুমাত্র অতি-ধনীদের জন্য নয়—এটি এমন একটি লক্ষ্য যা সঠিক কৌশলের মাধ্যমে যে কেউ অর্জন করতে পারে। আপনি একজন তরুণ পেশাজীবী হন যিনি প্রথম বেতন সঞ্চয় করছেন, বা একজন অভিভাবক যিনি আপনার সন্তানদের জন্য একটি সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ কামনা করেন, আপনার জীবদ্দশার বাইরেও সম্পদ স্থায়ী করা সম্ভব। এই পোস্টে, আমি সাতটি প্রমাণিত কৌশল শেয়ার করব যা আপনাকে বংশগত সম্পদ গড়তে সাহায্য করবে, যা সময়-পরীক্ষিত নীতি এবং বাস্তব-বিশ্বের উদাহরণ থেকে নেওয়া। আসুন, আপনার পরিবারের জন্য কয়েক দশক ধরে কীভাবে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করবেন তা নিয়ে আলোচনা করি।
বংশগত সম্পদ কী?
বংশগত সম্পদ বলতে এমন সম্পদ, বিনিয়োগ এবং আর্থিক সংস্থান যা এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয়, যা আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং বৃদ্ধির একটি চক্র তৈরি করে। এটিকে এমন একটি গাছ লাগানোর মতো ভাবুন যার ছায়া আপনার নাতি-নাতনিরা উপভোগ করবে। এটি শুধু ব্যাঙ্কে নগদ টাকা নয়—এর মধ্যে রয়েছে রিয়েল এস্টেট, ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং এমনকি মূল্যবান সংগ্রহযোগ্য জিনিস যা সময়ের সাথে মূল্য বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণস্বরূপ, কল্পনা করুন প্রিয়া, একজন স্কুল শিক্ষিকা, যিনি তার ৩০ বছর বয়সে একটি ছোট ভাড়ার সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করেছিলেন। কয়েক দশক ধরে, সেই সম্পত্তির মূল্য বৃদ্ধি পায়, এবং ভাড়ার আয় তার সন্তানদের জন্য একটি আর্থিক নিরাপত্তা জাল প্রদান করে। এটিই বংশগত সম্পদের বাস্তব প্রয়োগ। এটি এখনই স্মার্ট পছন্দ করার বিষয়, যা ভবিষ্যতে ইতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে।
কেন আপনার বংশগত সম্পদের বিষয়ে চিন্তা করা উচিত?
আপনার জন্য বংশগত সম্পদ কেন গুরুত্বপূর্ণ? আর্থিক সুবিধার বাইরেও, এটি আপনার পরিবারকে একটি শুরুতে এগিয়ে রাখার বিষয়—ঋণ থেকে মুক্তি, শিক্ষার সুযোগ বা আর্থিক চাপ ছাড়াই স্বপ্ন পূরণের ক্ষমতা। এটি ছাড়া, প্রতিটি প্রজন্মকে শূন্য থেকে শুরু করতে হতে পারে, যা আপনি যে আর্থিক বাধাগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন তা মোকাবেলা করতে হবে।
অর্জুনের কথা ভাবুন, একজন ২৮ বছর বয়সী আইটি পেশাদার। তিনি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ উপেক্ষা করেছিলেন, ধরে নিয়েছিলেন তার বেতন সবসময় তার চাহিদা পূরণ করবে। হঠাৎ চাকরি হারানোর পর তিনি হতাশ হয়ে পড়েন, কোনো সঞ্চয় ছিল না। যদি তার বাবা-মা বংশগত সম্পদ গড়ে তুলতেন, তাহলে অর্জুনের এই ঝড়ের মোকাবেলার জন্য একটি নিরাপত্তা জাল থাকত। এখনই সম্পদ গড়ে তোলা নিশ্চিত করে যে আপনার সন্তান বা নাতি-নাতনিরা একই ধরনের সংগ্রামের মুখোমুখি হবে না। এটি নিরাপত্তা এবং সুযোগের একটি উপহার।
বংশগত সম্পদ গড়ার ৭টি মূল কৌশল
এখানে সাতটি ব্যবহারিক, প্রমাণিত কৌশল দেওয়া হলো যা দীর্ঘস্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে, প্রতিটি স্ক্রিপ্টে ভাগ করা নীতির উপর ভিত্তি করে তবে ব্যবহারিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে প্রসারিত।
১. স্থিতিশীল, চিরস্থায়ী ব্যবসায় বিনিয়োগ করুন
ওয়ালটন (ওয়ালমার্ট) বা আম্বানি (রিলায়েন্স) এর মতো সফল পরিবারগুলো সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকা ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদ গড়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য বা প্রযুক্তির মতো স্থিতিশীল চাহিদা সম্পন্ন শিল্পের উপর ফোকাস করুন। একটি শক্ত ভিত্তির উপর ব্যবসা শুরু করা বা বিনিয়োগ করা নিশ্চিত করে যে এটি প্রজন্মের জন্য আয় উৎপন্ন করতে পারে।
২. ভাড়ার সম্পত্তি অর্জন করুন
রিয়েল এস্টেট, বিশেষ করে ভাড়ার সম্পত্তি, বংশগত সম্পদের একটি ভিত্তি। সম্পত্তি সময়ের সাথে মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং প্যাসিভ আয় প্রদান করে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমর্থন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আজ কেনা একটি সাধারণ ফ্ল্যাট ২০ বছর পরে আপনার সন্তানের শিক্ষার জন্য অর্থায়ন করতে পারে।
ব্যবহারিক পরামর্শ: একটি ক্রমবর্ধমান এলাকায় একটি সিঙ্গেল ভাড়ার ইউনিট দিয়ে ছোট থেকে শুরু করুন। ভাড়ার আয় ব্যবহার করে বন্ধক পরিশোধ করুন, তারপর লাভ পুনর্বিনিয়োগ করুন।
৩. উচ্চ-মূল্যের সম্পদ সংগ্রহ করুন (শিল্পকর্ম, সংগ্রহযোগ্য জিনিস, গাড়ি)
শিল্পকর্ম, ভিনটেজ গাড়ি বা সীমিত সংস্করণের সংগ্রহযোগ্য জিনিসে বিনিয়োগ বিশাল রিটার্ন দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটি পেইন্টিং ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিল, এবং ২০২২ সালে মাইকেল জর্ডানের একটি জার্সি ১০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছিল। এই সম্পদগুলো তাদের বিরলতা এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে মূল্য বৃদ্ধি পায়।
ব্যবহারিক পরামর্শ: সংগ্রহযোগ্য জিনিসে বিনিয়োগের আগে বাজার ভালোভাবে গবেষণা করুন এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করুন। ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক আবেদন সম্পন্ন জিনিসের উপর ফোকাস করুন।
৪. জমি কিনুন এবং ধরে রাখুন
জমি একটি সীমিত সম্পদ, এবং চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এর মূল্য সাধারণত বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে, জমি বিক্রি না করে ভাড়া বা বন্ধকের মাধ্যমে আয়ের জন্য ব্যবহার করা যায়, যা সম্পদ সংরক্ষণ করে।
ব্যবহারিক পরামর্শ: ক্রমবর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে জমিতে বিনিয়োগ করুন। মূল্য বৃদ্ধির জন্য ৫-১০ বছর ধরে রাখুন।
৫. সোনা, রুপো এবং রত্নপাথরে বিনিয়োগ করুন
মূল্যবান ধাতু এবং রত্নপাথর শতাব্দী ধরে সম্পদ সংরক্ষণের হাতিয়ার। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে তাদের মূল্য প্রায়ই বৃদ্ধি পায়, যা মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষা প্রদান করে। তবে, বৈশ্বিক সরবরাহ এবং চাহিদার কারণে তাদের দাম ওঠানামা করতে পারে।
ব্যবহারিক পরামর্শ: আপনার পোর্টফোলিওর একটি ছোট অংশ (৫-১০%) সোনা বা রুপোর ইটিএফ-এ বিনিয়োগ করুন। বাজারের অস্থিরতার কারণে অতিরিক্ত বিনিয়োগ এড়িয়ে চলুন।
৬. পারিবারিক ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করুন
ট্রাস্ট সম্পদ পরিচালনা এবং সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। টাটা এবং আম্বানির মতো পরিবার ট্রাস্ট ব্যবহার করে সম্পদ তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিতরণ নিশ্চিত করে, করের বোঝা কমিয়ে এবং উত্তরাধিকারীদের দ্বারা অপব্যবহার রোধ করে।
ব্যবহারিক পরামর্শ: আপনার লক্ষ্য অনুযায়ী একটি ট্রাস্ট তৈরি করতে একজন আর্থিক উপদেষ্টার সাথে পরামর্শ করুন, যেমন শিক্ষার জন্য তহবিল বা দাতব্য কাজে সমর্থন।
৭. আর্থিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিন
জ্ঞান ছাড়া সম্পদ ভঙ্গুর। আপনি এবং আপনার পরিবারকে অর্থ ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ এবং বাজেটিং সম্পর্কে শিক্ষিত করুন যাতে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, নষ্ট না হয়। আপনার সন্তানদের সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের মূল্য শেখান।
আজই কীভাবে বংশগত সম্পদ গড়া শুরু করবেন
কর্মে নামতে প্রস্তুত? এখানে আপনার যাত্রা শুরু করার জন্য একটি ধাপে ধাপে পরিকল্পনা দেওয়া হলো:
1. আপনার আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করুন: আপনার নেট ওয়ার্থ (সম্পদ বিয়োগ দায়) গণনা করুন আপনার শুরুর বিন্দু বোঝার জন্য।
2.স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন: বংশগত সম্পদ আপনার জন্য কী বোঝায় তা নির্ধারণ করুন—যেমন, ১০ বছরে দুটি ভাড়ার সম্পত্তি কেনা বা একটি ট্রাস্ট শুরু করা।
3. একটি বাজেট তৈরি করুন : সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের জন্য তহবিল বরাদ্দ করুন, দীর্ঘমেয়াদী সম্পদের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে।
4. ছোট থেকে শুরু করুন : একটি সম্পদ শ্রেণীতে বিনিয়োগ করুন (যেমন, একটি মিউচুয়াল ফান্ড বা ছোট জমির প্লট) এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ার সাথে সাথে স্কেল করুন।
5. বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন : আপনার লক্ষ্য এবং ঝুঁকি সহনশীলতার সাথে কৌশল সারিবদ্ধ করতে একজন আর্থিক পরিকল্পনাকারীর সাথে কাজ করুন।
বংশগত সম্পদ গড়ার সময় যে সাধারণ ভুলগুলো এড়ানো উচিত
সম্পদ গড়তে সময় লাগে, এবং ভুল পদক্ষেপ আপনার অগ্রগতি ব্যাহত করতে পারে। এখানে তিনটি সাধারণ ভুল এড়ানোর উপায় দেওয়া হলো:
দ্রুত লাভের পিছনে ছোটা : দ্রুত ধনী হওয়ার স্কিম তাত্ক্ষণিক সম্পদের প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু প্রায়ই ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়। প্রমাণিত, দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের উপর লেগে থাকুন।
বৈচিত্র্য উপেক্ষা করা : সমস্ত টাকা একটি সম্পদে রাখা (যেমন, শুধু স্টক বা শুধু রিয়েল এস্টেট) ঝুঁকি বাড়ায়। একাধিক শ্রেণীতে বিনিয়োগ ছড়িয়ে দিন।
আইনি সুরক্ষা উপেক্ষা করা : উইল বা ট্রাস্ট না করা বিবাদ বা করের ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। সম্পদ হস্তান্তরের জন্য তাড়াতাড়ি পরিকল্পনা করুন।
চূড়ান্ত চিন্তা
বংশগত সম্পদ গড়া হলো আজ বীজ বপন করা যাতে আপনার পরিবার আগামীকাল একটি সমৃদ্ধ বনভূমিতে বেড়ে উঠতে পারে। ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট, সংগ্রহযোগ্য জিনিস, জমি, মূল্যবান ধাতু, ট্রাস্ট এবং আর্থিক শিক্ষায় বিনিয়োগের মাধ্যমে, আপনি সুযোগের একটি উত্তরাধিকার তৈরি করছেন। যাত্রা শুরু হয় একটি একক পদক্ষেপ দিয়ে—আপনারটি কী হবে? এই পোস্ট থেকে একটি কৌশল বেছে নিন এবং এই সপ্তাহে এটি অন্বেষণ করার প্রতিশ্রুতি দিন। নিচে মন্তব্যে আপনার পরিকল্পনা শেয়ার করুন—আপনি কীভাবে আপনার পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করছেন তা শুনতে চাই!
ব্লগ লিখেছেন সন্তু দাস
ব্যক্তিগত আর্থিক শিক্ষক | প্রতিদিনের জীবনের জন্য অর্থ সহজ করা